নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ
স্টাফ রিপোর্টার : প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের চরম অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের কোনো দিক নির্দেশনা নেই এমনকি সাধারণ ও গরিব মানুষের জন্য কোনো ‘সুখবর’ও নেই বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এটি ‘বাস্তবতা বিবর্জিত, প্রতারণামূলক, লোক দেখানো বাজেট বলে অভিহিতি করেছেন তিনি। গতকাল বুধবার দুপুরে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটের ওপর দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সরকার শিক্ষার কথা বলে অথচ দাম বাড়ায় কলমের, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে দাম বাড়ায় ল্যাপটপ-মোবাইল ফোনের, গরিবের কথা বলে অথচ পরোক্ষ কর আরোপ করে নিত্য প্রয়োজনী জিনিসের উপর। এটি স্পষ্টতই জনগনের সাথে প্রতারণা। এই বাজেটে সাধারণ ও দরিদ্র জনগণের জন্য কোনো সুখবর নেই, নেই চরম অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের কোনো দিক নির্দেশনা। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিয়োগসহ সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে তা অর্জনযোগ নয় বলে আমরা মনে করি। এটি বাস্তবতা বিবর্জিত, প্রতারণামূলক, লোক দেখানো বাজেট, জনকল্যাণের নয়।
গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানে তিনি গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট দেশের প্রধান জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে সরকারের জাবাবদিহিতা থাকেনা। দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই জাতীয় সংকট থেকে মুক্তি পেতে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধমূলক নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটার একমাত্র পথ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশের চরম অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে প্রয়োজন ছিলো দল-মত ও ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্ব গিয়ে সাহসী ও বাস্তবসম্মত বাজেট প্রণয়ন। কিন্তু মোটা দাগে এই বাজেট আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) এর শর্ত বাস্তবায়ন এবং বিগত অর্থবছরের বাজেটের ১৪-১৫% বর্ধিত অবস্থা ছাড়া কিছুই না।
গুলশানে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে দুপুরে বিএনপি মহাসচিব জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত অর্থমন্ত্রীর দেয়া বাজেট প্রস্তাবনার বিভিন্ন দিক বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব প্রাপ্তি, আয়-বৈষম্য, করারোপে বৈষম্য, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের বোঝা, বাজেট বাস্তবায়নের অসম্ভাব্যতা, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি খাতে বরাদ্দের সাথে বাস্তবতার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। এই চাপ মোকাবেলায় প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন কোনো কার্য্কর পদক্ষেপ নেই্ বিদ্যুত, জ্বালানি, পরিবহন, খাদ্যসহ তেল, চাল, আদা, চিনি, ডিম, মুরগিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অনেক আগেই মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের তোনো পথরেখা না দিয়েই কিভাবে মূল্য স্ফীতির টার্গেট ৬% ঘোষণা করেছেন তা বোধগম্য নয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, বাজেটে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থপাচার প্রতিরোধে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। ক্ষমতার বলয়ের বাইরে সাধারণ মানুষের অনুকূলে এই বাজেট কোনো ভুমিকা রাখবে না। এটা গণবিরোধী বাজেট। স্মার্ট বাংলাদেশে এবার তারা স্মার্ট লুটপাটের বাজেট দিয়েছে। তারা চুরিতে স্মার্ট। ভোট চুরি, ব্যাংক চুরি, অর্থ পাচার...এসব কিছুতেই স্মার্টলি লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি করার, ব্যাংক লুটপাট, সিন্ডিকেট পরিচালনা, জনগনের সম্পদ লুটের পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে এই বাজেটে। এদেশটাকে লুটপাটের অংশীদার বানানো হয়েছে। সেজন্য বলতে চাই, এটা স্রেফ দুর্নীতিবাজ বর্তমান সরকারের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুটের লক্ষ্যে প্রণীত অর্থ লুটেরাদের বাজেট। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিখাতে বাজেটে বরাদ্দ কমানোর কঠোর সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়েনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজেট ও জিডিপির অনুপাতে এই খাতে বরাদ্দ কমেছে। বরাদ্দ বেশি দেখানোর কৌশল হিসেবে এই খাতে এমন কিছু কর্মসূচি দেখানো হয়েছে যা বাস্তবে সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষা কর্মসূচি নয়। এছাড়া কৃষি খাতে ভর্তুকি, সঞ্চয়পত্রের সুদ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দেওয়া প্রণোদনার টাকাকেও সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বয়স্ক নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ও প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা মাত্র ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকায় প্রতিবন্ধীরা বিক্ষোভ করেছে, পুলিশের পিটুনি খেয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে সরকারের জবাবদিহিতা থাকে না। দেশের অর্থনীতির জনকল্যাণকর বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জাতীয় সংকট থেকে মুক্তি পেতে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধমূলক নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা অবশ্যই করতে হবে। এটার একমাত্র পথ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহনমূলক ও সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান।
সংকট সমাধান নিয়ে ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চান না মির্জা ফখরুল। সাংবাদিক সম্মেলনে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন বিএনপি মহাসচিব একথা জানান। তিনি বলেন, আমি এই বিষয়টা গুরুত্ব দিতে চাই না। এ নিয়ে আমি কথাও বলতে চাই না । পরে বিকালে এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিবের কাছে বলেন, আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না। উনি আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল স্পোকস ম্যান কিনা এটা আমি জানি না। আমরা উনার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেবো কেনো? আই ডোন্ট মেক এ্যানি কমেন্ট।
মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ১৪ দলীয় জোটের এক সমাবেশে জোটের সমন্বয়ক আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেছেন, আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই। প্রয়োজনে অতীতের মতো জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের মধ্যস্থতায়ও সেই আলোচনা হতে পারে।
বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে প্রশ্ন করা হলে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু বলেন, আমাদের প্রশ্ন টাকা গেলো কৈ? সাধারণ মানুষ তো তাদের বিদ্যুতের বিল দিয়েই যাচ্ছে...এখানে কেউ বাকি নাই এবং উচ্চ মূল্যে দিচ্ছে, প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। তাহলে কেনো কয়লার জন্য এলসি খুলতে পারছে না, কেনো গ্যাসের এলসি খুলতে পারছে না, কেনো তেলের জন্য এলসি খুলতে পারছে না। আমাদেরও প্রশ্ন এই টাকা কোথায় গেলো? টাকাও নাই, ডলারও নাই। এই টাকা কোথায় গেছে আমরা সবাই জানি। বিদেশে সম্পদ কেনা হচ্ছে, সুইস ব্যাংকের টাকা রাখা হচ্ছে, তারপরে অফসর ব্যাংক এক্উান্টে টাকা রাখা হচ্ছে...এগুলো ইতিমধ্যে আমরা জেনেই গেছি। কারা এই টাকার মালিক এটাও দেশের মানুষ কমবেশি জানা হয়ে গেছে।
বিদ্যুতের সংকট সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সারাদেশে বিদ্যুতের লোডশিডিংয়ে সকলের ক্রাহি অবস্থা। অথচ উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের ফেরি করে বিক্রি করতে হবে পার্লামেন্টে অহমিকা করেছে সরকার। বিদ্যুতের এই সংকটের মূল কারনটাই হচ্ছে দুর্নীতি লুটপাট। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে শুরু করে আদানি পর্যন্ত পুরোটাই লুটপাট। এই খাতকে তারা বেছে নিয়েছে যে, সর্বোচ্চ দুর্নীতি করা হবে বিদ্যুত খাত থেকে। আমরা সেমিনার করে বলেছিলাম, মাত্র ১০টি কোম্পানি যারা ক্যাপাসিটি ট্যাক্সের সবচেয়ে বেশি সুবিধা উপভোগ করছে। এরা সবাই সরকারের সঙ্গে জড়িত।বিদ্যুত খাতে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে এই খাতকে পুরোপুরি প্রাইভেট সেক্টারে প্রায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। যার ফলে আজকে এই সংকট দেখা দিয়েছে সেখানে প্রফিট ছাড়া আর কিছু কাজ করছে না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাজেটে আয় বৃদ্ধির জন্য কর্মসংস্থানের বিশেষ কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ করা হয়নি। আর কর্মসংস্থান না হলে মানুষের আয় বাড়বে না। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা তারা সামলাবে কিভাবে ? সরকার ইতোপুর্বে করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তিদেরও ৪৪ ধরনের সেবা গ্রহণে টিন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে যা মধ্যবিত্তের উপর জুলুম। প্রশ্ন হলো যার আয় কম তিনি কি ঐ সকল রাষ্ট্রীয় সেবা পাবেন না! একদিকে ন্যূনতম আয়কর সীমা বাড়িয়ে ৩,৫০,০০০ টাকা প্রস্তাব করেছে, অপরদিকে আয় না থাকলেও মিনিমাম ২০০০ টাকা আয়কর ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে যা সাংঘর্ষিক, ন্যায়নীতি বর্জিত এবং ‘আয়ের উপর কর’ নীতিরও পরিপন্থী। প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ার বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারীর জন্য কোন আশার আলো নেই। শেয়ার বাজার বিপর্যয়ের উপরে গঠিত তদন্ত রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাজেট ও জিডিপির অনুপাতে এ খাতে বরাদ্দ কমেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়-বৈষম্য নিরোধের কৌশল সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। উপরন্তু পক্ষপাতমূলক নীতিকাঠামো আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়াচ্ছে। গত ১২ বছর ধরে দেশের গিনি সহগ ঊর্ধ্বমুখী যা ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯৯ এ পৌঁছেছে। দেশে যখন ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে, এই বাজেটে প্রস্তাবিত করনীতি তা আরও কয়েকগুন বাড়াবে।
সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।